লড়াই শুরু রাজ্য বিজেপির দফতর মুরলীধর সেন লেনের অফিস ভাঙা নিয়ে। শনিবার ভেঙে ফেলা হয়েছে প্রাক্তন রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহল সিনহার অফিস। ভাঙা হচ্ছে দিলীপ ঘোষের ঘরটিও।এটি নিয়ে শুরু হয়েছে আদি- নব্য লড়াই ।
রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, কোনও ভেদাভেদ নেই। শুধু রাহুল সিনহা বা দিলীপদার ঘর ভাঙা হয়নি। সবার ঘরেই হাত পড়েছে। বিজেপি অফিসের রি-মডেলিং হচ্ছে। ঘোলা জলে কেউ মাছ ধরার চেষ্টা করছে।
বঙ্গ বিজেপিতে আদি-নব্য দ্বন্দ্ব চিরকালের। সম্প্রতি আদিরা যে বিজেপিতে কোণঠাসা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।বিজেপিতে এই আদি- নব্য লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক পুরনো।
মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়ে যখন বিজেপি তে আসেন ও বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির পদ পান তখন ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন বঙ্গ বিজেপির সে সময়ের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল সিনহা। সেটাই ছিল বাংলার বিজেপিতে বিদ্রোহের প্রথম প্রকাশ্যে আসা আগুন।এদিকে সে সময় তৃণমূল থেকে আসা আরেক নেতা অনুপম হাজরাকে কেন্দ্রীয় সম্পাদক করা হয়। কেন্দ্রীয় সম্পাদক পদ থেকে রাহুলকে সরাতেই নিজের ফেসবুক পেজে ভিডিও পোস্ট করেছিলেন তিনি। দলের এই সিদ্ধান্তে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হন রাহুল সিনহা।
তিনি দল ছাড়তে পারেন এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছিল সে সময়। রাহুলের মানভঞ্জন করতে ময়দানে নেমেছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কোনওমতে সামাল দেওয়া গিয়েছিল পরিস্থিতি।
মুকুল রায় বিজেপিতে যাওয়ার পর থেকেই দিলীপের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে আসে। অনেক সময়ই মুকুলের সঙ্গে দিলীপ ঘোষের বিবাদ প্রকাশ্যে আসতে দেখা গিয়েছে।তবে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিয়ে কোনও পক্ষই সে সময় সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি। অসুস্থ মুকুলকে দেখতে যেমন হাসপাতালে যেতে দেখা গিয়েছিল দিলীপকে । তেমনি মুকুল স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, বঙ্গ বিজেপিতে মুকুল-দিলীপ দ্বন্দ্ব জল্পনা ভিত্তিহীন। তাঁর সঙ্গে বাংলার বিজেপি সভাপতির কোনও বিরোধ নেই।
কিছুদিন আগেও বঙ্গ বিজেপি-র অন্দরেই কান পাতলে শোনা যেত, মঞ্চে গলায়-গলায় ভাব দেখালেও দিলীপ ঘোষ-শুভেন্দু অধিকারীর সম্পর্কে একটা ‘শৈত্য’ রয়েছে। তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানোর পর থেকেই দলে আলাদা গুরুত্ব পেয়েছিলেন শুভেন্দু । তাতে কিছুটা হলেও কোণঠাসা হয়েছিলেন বিজেপির সেসময়ের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ।
আদি -নব্য প্রশ্ন তখনো উঠেছিল যখন পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূল বিধায়ক তথা আসানসোল পুরসভার প্রাক্তন প্রশাসক জিতেন্দ্র তিওয়ারির বিজেপি-তে যোগদানের করেছিল । দলের একটা বড় অংশ সে সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন, আসানসোলে যখন বিজেপি পর পর দু’বার লোকসভা নির্বাচনে জিততে পেরেছে, তখন দলের এতটা ‘জিতেন্দ্র-নির্ভরতা’ কেন!
অনেকে এমনও বলেন যে, লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি কর্মীদের মূল লড়াইটাই ছিল জিতেন্দ্রর বিরুদ্ধে! যদিও সেই প্রশ্ন বা যুক্তিকে আমল দেননি বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। জিতেন্দ্র নিয়ে প্রকাশ্যে ‘দলের বিরোধী’ মন্তব্য করায় শো-কজ করা হয়েছিল সে সময়ের দলের সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু, মহিলা মোর্চা সভানেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল-সহ চার জনকে।
দিলীপ ঘোষ বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদ খুয়েছিলেন একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর পর। সম্প্রতি খোয়ান বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতির পদও। এখন আর বঙ্গ বিজেপিকে দিলীপ ঘোষ ও রাহুল সিনহাদের সময়ের কার্যকর্তাদের দেখা যায় না সেভাবে। সায়ন্তন বসু, রীতেশ তিওয়ারি, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়রা এখন অতীত। এখন দলের নতুনদেরই রমরমা।
এখানে উল্লেখ্য দিলীপ ঘোষ বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসেবে সর্বাধিক সফল।তাঁর আমলেই বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বাংলায় ১৮টি আসন পেয়েছিল । যা তার আগে কখনই তিনের বেশি ছিল না। আর ২০২১-এর বিধানসভায় ২০০ আসন না জিতলেও ৭৭টি আসন নিয়ে বিজেপি প্রথমবার বাংলার বিধানসভায় বিরোধী আসনে বসেছিল।
একুশের নির্বাচনের পরে বিজেপিতে নয়া মুখ আনা হয়। দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে আনা হয় তরুণ-তুর্কি নেতা সুকান্ত মজুমদারকে। আর তৃণমূল থেকে আসা শুভেন্দু অধিকারী তো ছিলেনই।শুভেন্দু অধিকারী লড়াইটা সঠিক ভাবেই চালাচ্ছেন কিন্তু সুকান্ত-শুভেন্দুদের জমনায় অনেকটাই কোণঠাসা দিলীপ ঘোষ ও রাহুল সিনহারা।
এখনও পুরনো দিনের বিজেপির একনিষ্ঠ কার্যকর্তারা দলের জন্য লড়াইয়ে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের আর কেউ মনে রাখেনি। তাদের আর কেউ ডাকে না।। একুশে নির্বাচনের পরে বাংলায় ১০-১০টি ভোট হয়েছে, কোনও ভোটেই মুখ ফেরানো আদি বিজেপি নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি সেভাবে। তার প্রভাবও পড়েছে ভোটব্যাঙ্কে।
ফলে লোকসভা নির্বাচন ২০২৪-এর আগে বিজেপির সঙ্কট বাড়ছে। বছর ঘুরলেই বেজে যাবে ভোটের দামামা। তার আগে বিজেপিতে এই ‘গৃহযুদ্ধ’ই বুমেরাং হতে পারে। গেরুয়া শিবিরকে আদি-নব্য সংঘাতের মাসুল গুণতে হতে পারে।