আধ্যাত্মিকতার মহাযজ্ঞ “মহাকুম্ভ”। প্রয়াগ কুম্ভ মেলা শুধু একটি মেলা বা ধর্মীয় সমাবেশ না এটি হিন্দু আধ্যাত্মিকতার মিলনক্ষেত্র। এটা সনাতনী হিন্দু সমাজের প্রাণের উৎসব যেটি ভারতের প্রয়াগরাজ শহরে গঙ্গা, যমুনা এবং পৌরাণিক সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল ত্রিবেণী সঙ্গমে অনুষ্ঠিত হয়। এই স্থান, এর পবিত্রতা, স্নান তীর্থযাত্রা এবং বার্ষিক উৎসবের উল্লেখ প্রাচীন পুরাণ এবং মহাকাব্য মহাভারতে রয়েছে।
কুম্ভ মেলার প্রকারভেদ
ক) মহা কুম্ভ মেলা: এটি শুধুমাত্র প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হয়। এটি প্রতি ১৪৪ বছরে বা ১২টি পূর্ণ (সম্পূর্ণ) কুম্ভ মেলার পরে আসে।
খ ) পূর্ণ কুম্ভ মেলা: এটি প্রতি ১২ বছরে আসে। প্রধানত ভারতের ৪টি কুম্ভমেলা স্থানে যেমন প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, নাসিক এবং উজ্জয়িনে অনুষ্ঠিত হয়। এটি প্রতি ১২ বছরে এই ৪টি স্থানে ঘোরে।
গ ) অর্ধ কুম্ভ মেলা: এর অর্থ হল অর্ধ কুম্ভ মেলা যা প্রতি ৬ বছরে ভারতে শুধুমাত্র হরিদ্বার এবং প্রয়াগরাজে দুটি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়।
ঘ ) কুম্ভ মেলা: চারটি ভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় এবং রাজ্য সরকারগুলি দ্বারা সংগঠিত হয়। লাখ লাখ মানুষ আধ্যাত্মিক উদ্দীপনা নিয়ে অংশগ্রহণ করে।
ঙ) মাঘ কুম্ভ মেলা: এটি মিনি কুম্ভ মেলা নামেও পরিচিত যা বার্ষিক এবং শুধুমাত্র প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হয়। এটি হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মাঘ মাসে আয়োজিত হয়।
কুম্ভ মেলা ভারতের চারটি ভিন্ন রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়
- ১) প্রয়াগরাজ (উত্তরপ্রদেশ)
- ২) হরিদ্বার (উত্তরাখণ্ড)
- ৩) উজ্জয়িনী (মধ্যপ্রদেশ)
- ৪) নাসিক (মহারাষ্ট্র)
এই স্থানগুলির প্রত্যেকটি ভারতের পবিত্র নদী – গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী (প্রয়াগরাজ), গঙ্গা (হরিদ্বার), গোদাবরী (নাসিক) এবং শিপ্রা (উজ্জয়িনী) এর সাথে যুক্ত। অবস্থানের উপর নির্ভর করে, ধর্মীয় তাৎপর্য এবং আচার-অনুষ্ঠান পরিবর্তিত হতে পারে, তবে পবিত্র নদীতে স্নানের মূল ঐতিহ্য স্থির থাকে।
পৌরাণিক কাহিনী
দেবাসুর যুদ্ধের পরে, উভয় দেবতা এবং অসুর অমৃত পাওয়ার জন্য সমুদ্র মন্থন করতে সম্মত হন। সাপের রাজা, বাসুকিকে সমুদ্র মন্থনের জন্য মেরু পর্বতের চারপাশে দড়ি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা হয় । তদনুসারে বাসুকি দড়িতে পরিণত হন এবং মেরু পর্বতের চারপাশে বাঁধা হয়। সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে চৌদ্দটি অনন্য বস্তুর উদ্ভব হয়- বিষ, কামধেনু (একটি ইচ্ছা পূরণকারী গাভী), উচ্ছাই-আশ্রব (একটি সাদা ঘোড়া), ঐরাবত (চারটি দাঁত বিশিষ্ট একটি হাতি), কৌস্তুভ মণি (একটি হীরা), পারিজাত কল্পবৃক্ষ (একটি ইচ্ছা পূরণকারী গাছ), দেবাঙ্গনাস (আকাশীয় কুমারী), শ্রী লক্ষ্মীদেবী (শ্রীবিষ্ণুর সহধর্মিণী), সুরা , সোম (চন্দ্র), হরিধানু (একটি দিব্য ধনুক), একটি শঙ্খ, ধন্বন্তরী এবং অমৃতকলশ বা অমৃতকুম্ভ (অমৃতের পাত্র)। এই মন্থনে বিষ উঠে এলে দেবাদিদেব মহাদেব সেই বিষ তাঁর কন্ঠে ধারণ করেন, তাই তিনি নীলকন্ঠ। ধন্বন্তরী যখন অমৃত কলশ নিয়ে উঠে আসেন তখন সেটিকে নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
দেবতা ধন্বন্তরী যখন অমৃতকুম্ভ ধারণ করে সাগর থেকে আবির্ভূত হন, তখন দেবতারা ভেবেছিলেন যে, অমৃত পান করে অসুররা যদি অমর হয়ে যায়, তাহলে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। তারা ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্তকে ইঙ্গিত করেন। জয়ন্ত অবিলম্বে দেবতা ধন্বন্তরীর কাছ থেকে অমৃতকুম্ভ নিয়ে স্বর্গের দিকে ছুটে গেলেন। অমৃতকুম্ভ ধরার জন্য, দেবতা এবং অসুররা ১২ দিন এবং ১২ রাত ধরে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করেছিল। এই দেব ও অসুরের ১২ দিন যুদ্ধ যা মানুষের জন্য ১২ বছর কে ইঙ্গিত করে।
অমৃতকে রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জয়ন্ত পালিয়ে যাওয়ার সময়, অমৃতের ফোঁটা পৃথিবীর চারটি স্থানে হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জয়িনী এবং প্রয়াগরাজে পড়েছিল। ঐশ্বরিক অমৃত দ্বারা স্পর্শ করা এই স্থানগুলি কুম্ভ মেলার জন্য পবিত্র স্থান হয়ে ওঠে। বিষ্ণুর আদেশ অনুসরণ করে, সূর্য, চন্দ্র, শনি এবং বৃহস্পতিও অমৃত কালাশকে পাহারা দিয়েছিল, যার ফলে এই সূর্য,চন্দ্র,শনি ও বৃহস্পতি নির্দিষ্ট রাশিচক্রে প্রবেশ করলে কুম্ভ মেলা আয়োজিত হয়।
জ্যোতিষশাস্ত্রীয় গণনা অনুসারে, কুম্ভ মেলা চারটি ভিন্ন উপায়ে উদযাপিত হয়:
- যখন বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে প্রবেশ করে এবং সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে, তখন হরিদ্বারে গঙ্গার তীরে কুম্ভ উৎসব হয়।
- যখন বৃহস্পতি মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং সূর্য ও চন্দ্র উভয়ই মকর রাশিতে প্রবেশ করে, তখন প্রয়াগরাজের ত্রিবেণী সঙ্গমে কুম্ভ উৎসব পালিত হয়।
- বৃহস্পতি এবং সূর্য যখন সিংহ রাশিতে প্রবেশ করে, তখন নাসিকের গোদাবরীর তীরে কুম্ভ উৎসব হয়।
- যখন বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে প্রবেশ করে এবং সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে, তখন উজ্জয়িনীতে শিপ্রার তীরে কুম্ভ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
কুম্ভ মেলার ইতিহাস (বিভিন্ন সূত্রে কুম্ভ মেলার উল্লেখ)
বিভিন্ন পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও ‘কুম্ভ মেলা’র উল্লেখ আছে। ‘নারদ-পুরাণ’-এ ‘কুম্ভ-মেলা’কে খুব ভালো বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
- ক) কিছু পণ্ডিতদের মতে, এই মেলাটি ৩৪৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয়েছিল অর্থাৎ এটি হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো সংস্কৃতির ১০০০ বছর আগে বিদ্যমান একটি ঐতিহ্য।
- খ) ২৩৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, বিশ্বামিত্র (দ্বিতীয়) ‘মাঘ পূর্ণিমা’ তে পবিত্র স্নানের গুরুত্ব বর্ণনা করেছিলেন।
- গ) ১৩০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মহর্ষি জ্যোতিষ ‘মাঘ পূর্ণিমায়’ পবিত্র স্নানের গুরুত্ব জনগণকে প্রভাবিত করেছিলেন।
- ঘ) ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে (৫৯০-৬৪৭ খ্রি:) কুম্ভমেলা বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং (৬৩০ খ্রি:) তার ভ্রমণকাহিনীতে কুম্ভ মেলার মহিমা নথিভুক্ত করেছেন ও রাজা হর্ষবর্ধনের উদারতা তুলে ধরেছেন। রাজা পবিত্র নদীগুলি যেখানে মিলিত হয় সেই বালির উপর প্রতি পাঁচ বছর পরপর একটি মহাসম্মেলন করেন ও সমস্ত শ্রেণীর দরিদ্র ও ধার্মিক লোকেদের মধ্যে তার সম্পদ বিতরণ করতেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এটি তার বংশধরদের দ্বারা অব্যাহত ছিল বলেও জানা যায়।
সাধারণ সন্ন্যাসী ও সাধারণ জনগণ ছাড়া যে ১৩ টি আখড়া মূলত এই কুম্ভ মেলায় অংশগ্রহণ করে সেগুলি হল
- ১) ৭টি শৈব আখড়া: মহানির্বাণী, অটল, নিরঞ্জনী, আনন্দ, জুনা, আবাহন এবং অগ্নি
- ২) ৩টি বৈষ্ণব আখড়া: নির্বাণী, দিগম্বর এবং নির্মোহী
- ৩) ৩টি শিখ আখড়া: বড় পঞ্চায়েতি উদাসীন, ছোট পঞ্চায়েতি উদাসীন এবং নির্মল।
২০২৫ সালের মহা কুম্ভের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তারিখ
- ১) পৌষ পূর্ণিমা (স্নান) – ১৩ই জানুয়ারী ২০২৫
- ২) মকর সংক্রান্তি (স্নান) – ১৪ই জানুয়ারী ২০২৫
- ৩) মৌনী অমাবস্যা (স্নান) – ২৯শে জানুয়ারী ২০২৫
- ৪) বসন্ত পঞ্চমী (স্নান ) – ৩রা ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- ৫) অচলা সপ্তমী (স্নান ) – ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- ৬) মাঘী পূর্ণিমা (স্নান) – ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- ৭) মহা শিবরাত্রি (স্নান) – ২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫